কমলেন্দু সরকার: উত্তমকুমার যে খুশি মনে ফুরফুরে আছেন তা বোঝা যেত তাঁর হরিধ্বনি– হরি বোল্ শুনলেই। এ-হরি বোল্ অবশ্যই শ্মশানযাত্রীর হরিধ্বনি নয়, এ ছিল তাঁর আনন্দের ধ্বনি। যিনি নিজের চেষ্টায় বড় হয়েছেন। ফ্লপ নায়ক থেকে হয়েছেন মহানায়ক। তিনিই ছিলেন ইন্ডাস্ট্রি। তবু্ও এতটুকু দেমাক ছিল না। যাঁরা তাঁর দুঃখের দিনে সঙ্গী ছিলেন বরাবরই তাঁদের সঙ্গে থেকে গেছিল অটুট বন্ধন। সেই তালিকায় সামান্য টেকনিশিয়ান, স্পটবয় থেকে পরিচালক, অভিনেতা সকলেই। তাই তিনি যখন স্টুডিয়োয় ঢুকে হরিধ্বনি দিতেন তখন সকলেই একসঙ্গে বলে উঠতেন– হরি বোল্। শোনা যায়, নতুন ছবির শুটিং শুরুর দিন বর্ষীয়ানদের পা-ছুঁয়ে প্রণাম করে আশীর্বাদ চাইতেন।
উত্তমকুমার নামটির মধ্যেই যেন লুকিয়ে আছে ম্যাজিক, লুকিয়ে আছেশিহরন! তিনি ছিলেন বাংলা ছবির রাজকুমার। তিনি ছিলেন বাংলা ছবির গ্ল্যামার কিং। কিন্তু চিরকালই তিনি পিয়ালা-পিরিচে চা খেতেন না, তিনি পছন্দ করতেন স্টুডিয়ো ক্যান্টিনের সস্তা পলাকাটা কাচের গ্লাসে চা। যা তিনি হাতে তুলে নিয়েছিলেন টালিগঞ্জের স্টুডিয়ো প্রবেশাধিকারের প্রথম দিনই। শেষদিন পর্যন্ত তা আর হাতছাড়া করেননি। যেমন, ছাড়েননি বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে আড্ডা, হল্লা ইত্যাদি। পুরনো বন্ধুবান্ধব এবং পাড়শীদের নিয়ে মঞ্চবেঁধে যাত্রা করা। বহুদিন পর্যন্ত করেছিলেন পাড়ার যাত্রা। যা একসময় ছিল তাঁর নেশা। পাড়ার ‘জলি সেলুন’-এ চুল কাটতেন। এই সেলুন থেকে এসেছিল ‘ইউ কাট’। যা একসময় বাঙালির প্রিয় হয়ে উঠেছিল। সেইসময় প্রতিটি পাড়ার অলিগলির সেলুনে ইউ ছাঁট ছাড়া অন্য হেয়ার কাট প্রায় কিছু চলতই না। এ-নিয়ে বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারের বড়দের কঠিন শাসন অমান্য করেও যুবাদের ফ্যাশন করতেন ইউ কাট-এ।
উত্তমকুমারের জনপ্রিয়তা কতটা ছিল, তা বলে বোঝানো যায় না। কয়েকবার তাঁকে দেখার সুযোগ ঘটেছিল। তবে সবচেয়ে কাছ থেকে দেখার সুযোগ আসে সত্তর দশকের প্রায় গোড়ায়। তিনি সেইসময় ‘বনপলাশীর পদাবলি’র শুটিং করেছিলেন হাওড়ার জগৎবল্লভপুরে। আমরা কোনও এক কারণে দিন কয়েকর জন্য গেছিলাম। তা খবর পেলাম উত্তমকুমার সিনেমার শুটিং করছেন। তিনি এই ছবিটির পরিচালকও বটে। লক্ষ করেছিলাম সকলের সঙ্গেই তাঁর সুমধুর ব্যবহার। শট শুরু হবে সকলকেই বুঝিয়ে দিলেন কার কি দায়িত্ব। নিজেও চিত্রনাট্যে চোখ বুলিয়ে নিলেন কার কি দায়িত্ব। শুটিং শুরুর ঠিক মুখেই বিভৎস জোরে চেঁচিয়ে উঠলেন মাঠ এবং পুকুরের ওপারে যিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন তাঁর উদ্দেশে। ব্যাপারটা জানা গেল, তাঁকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল ফ্রেমে কেউ যেন না-ঢোকে। তা এক গ্রামবাসী অজান্তেই ঢুকে পড়েন। তাই তাঁর প্রতি পরিচালক-অভিনেতা উত্তমকুমারের ধমক। তিনি তখন শ্যামল মিত্রের গাওয়া ‘দেখুক পাড়া পড়শীতে কেমন মাছ গেঁথেছি বঁড়শিতে’। তারপর শুটিং হল নির্বিঘ্নে।
(ঋণ স্বীকার: সিনেমাপাড়া দিয়ে, তরুণ মজুমদার, দে’জ)