শ্যামল কর
মরাঠি নাটকের অভিনেতা ও শাস্ত্রীয় সঙ্গীত অনুরাগী দীননাথ মঙ্গেশকর তাঁর পাঁচ বছরের মেয়ে হেমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন ‘ভাব বন্ধন’ নাটকে অভিনয় করানোর জন্য। লতিকা চরিত্রে কন্যার সুঅভিনয় দেখে বাবা হেমার নাম বদলে রাখলেন লতা।লতার মধ্যে অভিনয়প্রতিভার পাশাপাশি ছিল চমৎকার সুরেলা কণ্ঠ। সেইসময়ের বিখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী ও অভিনেতা কুন্দনলাল সায়গল যাঁর পরিচিতি ছিল কে এল সায়গল নামে, তাঁর গান লতাকে মুগ্ধ করত। বাবা দীননাথও চাইতেন মেয়ে ধ্রুপদী গান নিয়েই থাকুক। আর এক বিখ্যাত কণ্ঠশিল্পী ও অভিনেত্রী নুরজাহান-এরও ভক্ত ছিল লতা। সংঙ্গীত জীবনের শুরুতে তাঁকেই অনুকরণ করে গান গাইতেন।পরে ধীরে ধীরে গান গাওয়ার নিজস্ব শৈলী গড়ে তুললেন। তিনি হয়ে উঠেছিলেন বলিউডে সিনেমার গানের লতা মঙ্গেশকর।
লতা মঙ্গেশকর মানেই সুরের মূর্ছনা, লতা মঙ্গেশকর মানেই সুরেলা কণ্ঠে সুরের মাধুরী, সুরের জাদুতে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখা, লতা মঙ্গেশকর মানেই কোটি কোটি শ্রোতার হৃদয় জয় করা সঙ্গীত জগতের সর্বোজ্জ্বল নক্ষত্র।
১৯২৯-এর ২৮ সেপ্টেম্বর মধ্যপ্রদেশের ইন্দোরে জন্ম লতা মঙ্গেশকরের।শিশুকালেই বাবার সঙ্গে চলে আসেন মহারাষ্ট্রে। ১৩ বছর বয়সে বাবা মারা গেলে সংসারে আর্থিক অবস্থার অবনতি ঘটে। পরিবারের সব দায়িত্ব এসে পড়ে পাঁচ ভাই-বোনের বড় লতার ওপর। শুরু করেন পেশাদারি গান ও অভিনয়। দু’-একটি ছোট চরিত্রে অভিনয় করলেও গানকেই তিনি বেছে নেন উপার্জনের পথ। মঞ্চে গান গেয়ে তাঁর প্রথম উপার্জন ছিল ২৫ টাকা। ১৯৪৮ সালে সংগীত পরিচালক গোলাম হায়দার লতা মঙ্গেশকরকে নিয়ে যান বলিউডের প্রযোজক শশধর মুখার্জির কাছে। কিন্তু লতার কণ্ঠ অতিরিক্ত চিকন মনে হওয়ায় তিনি কাজ দিতে রাজি হননি। ক্ষুব্ধ গোলাম হায়দার বলেছিলেন, “আজ লতাকে ফিরিয়ে দিচ্ছেন, কিন্তু আমি যতটুকু সঙ্গীত বুঝি তাতে একদিন প্রযোজক-পরিচালকরা লতার পায়ে লুটিয়ে ভিক্ষা চাইবেন। তাঁদের ছবিতে লতার একটা গান গাওয়ার জন্য। গোলাম হায়দারের কথাটা অক্ষরে অক্ষরে মিলেছিল তার প্রমাণ পাওয়া গেল পরবর্তী কালে। লতা মঙ্গেশকর ছবিতে প্রথম গান গেয়েছিলেন মরাঠি ছবি ‘কিতি হাসাল’-এ। তবে তাঁর গাওয়া সব গান গ্রহণ করা হয়নি। তাঁর কাছে প্রথম বড় সুযোগ আসে হিন্দি ছবি ‘মজবুর’-এ। আর আসমুদ্রহিমাচলে তাঁকে জনপ্রিয় করে তোলে মধুবালা অভিনীত ‘মহল’ ছবির ‘আয়েগা আনেওয়ালা’ গানটি। এরপর হিন্দি ছবির গানে অপরিহার্য হয়ে ওঠেন লতা মঙ্গেশকর। এক হাজারের বেশি ছবিতে তিনি গান গেয়েছেন। বলিউডের প্রায় সব সংগীত পরিচালকের সঙ্গে কাজ করেছেন। শুধু হিন্দি ছবি নয়, ৩৬টি আঞ্চলিক এবং বিদেশি ভাষায় ২৫ হাজারেরও বেশি গান গাওয়ার একমাত্র রেকর্ড তাঁরই। ১৯৭৪ সালে গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ড বইয়ে তিনি স্থান পেয়েছেন সবথেকে বেশি গানের শিল্পী হিসাবে।১৯৫৯ সালে ফিল্মফেয়ারে সেরা গায়কের পুরস্কার দেওয়ার প্রচলন শুরু হলে, প্রথম পুরস্কারটি লাভ করেন লতা মঙ্গেশকর। পেয়েছিলেন ফিল্মফেয়ার আজীবন সম্মাননা পুরস্কার। তিনি পেয়েছেন– ভারতরত্ন, মহারাষ্ট্রভূষণ, পদ্মভূষণ, পদ্মবিভূষণ, দাদা সাহেব ফালকে, এনটিআর জাতীয় পুরস্কার, ফ্রান্সের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা অফিসার দ্য নর। আর গতবছর তাঁর জন্মদিনে ভারত সরকার তাঁকে ‘ডটার অফ দ্য নেশন’ খেতাবে ভূষিত করেন।
Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.