শ্যামল কর
১৯৫৯-এর ২৭ অগস্ট, ইংলিশ চ্যানেলের জল কনকনে ঠান্ডা। ওই ঠান্ডায় সাঁতার কেটে চলেছেন উত্তর কলকাতার এক বাঙালি মহিলা। তাঁর পাশেই সাঁতার কাটছেন ১৯৪৮-এর লন্ডন অলিম্পিকের স্বর্ণপদক জয়ী গ্রেটা অ্যান্ডারসন। এর চার বছর পর ১৯৫২-র হেলসেঙ্কি অলিম্পিকে ছিলেন উত্তর কলকাতার ওই বাঙালি সাঁতারু ভারতের সর্বকনিষ্ঠ প্রতিনিধি। যাইহোক, ১৪ ঘণ্টা ১০ মিনিট সাঁতার কাটা হয়ে ওই বাঙালিনির। গন্তব্যে পৌঁছাতে আর মাত্র তিন মাইল বাকি। যে-বোটম্যানকে তিনি অনুসরণ করে চলছিলেন সেই বোট একটু ঘুরপথে নিয়ে গেলে তিনি পড়লেন বিপরীত স্রোতের মুখে। ইংলিশ চ্যানেলে বিপরীত স্রোতে সাঁতার কাটা খুবই কষ্টকর। তবুও আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছেন। পরে সেই অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, “প্রচন্ড ঠান্ডা জলে হাত-পা সিটিয়ে যাচ্ছিল। শরীর অবশ হয়ে আসছিল। মনে হচ্ছিল জলন্ত উনুন পেটের কাছে থাকলে ভাল হয়। পাশ দিয়ে একটা কচ্ছপ ভেসে যাচ্ছে দেখে মনে হল তার পিঠে উঠে বসি।” স্রোতের টানে আর এগোতে পারছে না দেখে বোটম্যান গিয়ে তাঁকে স্পর্শ করলে নিয়ম অনুযায়ী সেই সাঁতার বাতিল হয়ে যায়। সাময়িক কষ্ট পেলেও, মন ভাঙেনি ওই বাঙালি মহিলা সাঁতারুর। একমাস পরই ২৯ সেপ্টেম্বর ভোর ৫টা ৫৫ মিনিটে ফ্রান্সের ‘কেপ গ্রিস নে’ থেকে আবার ইংলিশ চ্যানেলের জলে ঝাঁপালেন৷ ঠিক পাঁচদিন আগে ২৪ সেপ্টেম্বর গেছে তাঁর জন্মদিন। এবারে গাইড হিসেবে পেলেন ক্যাপ্টেন হার্টিনসনকে। ৪২ মাইল পথ অতিক্রম করে পৌঁছলেন ইংল্যান্ডের ‘স্যান্ডগেটে’। সময় নিলেন ১৬ ঘণ্টা ২০ মিনিট। তবে না, এখনও ইংলিশ চ্যানেল জয় করা হয়নি। নিয়ম অনুযায়ী জল থেকে ডাঙায় উঠে ১০ গজ হেঁটে যেতে হবে প্রতিযোগীকে। সেই ১০ গজ হেঁটে গিয়ে অবশেষে এশিয়ার প্রথম মহিলা সাঁতারু হিসেবে ইংলিশ চ্যানেল জয় করলেন। অদম্য সাহসী বাঙালি মহিলা আরতি সাহার বয়স তখন মাত্র ১৯ বছর ৫ দিন।
আরতি সাহার জন্ম ১৯৪০-এর ২৪ সেপ্টেম্বর। উত্তর কলকাতার তারক চ্যাটার্জি লেনে এক নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে। বাবা পাঁচুগোপাল সাহা সামান্য চাকরি করতেন বৃটিশ সেনাবাহিনীতে। আড়াই বছর বয়সে মা মারা গেলে, ঠাকুমার কাছেই বেড়ে ওঠা আরতির।চার বছর বয়সেই কাকা বিশ্বনাথের সঙ্গে আরতি স্নান করতে যেতেন চাঁপাতলার গঙ্গার ঘাটে। জলের নেশা তখন থেকেই। উৎসাহ দেখে মেয়েকে হাটখোলা সুইমিং ক্লাবে ভর্তি করে দিয়েছিলেন বাবা। শিক্ষাগুরু শচীন নাগের তত্ত্বাবধানে এক বছর সাঁতার কেটে শৈলেন্দ্র মেমোরিয়াল সাঁতার প্রতিযোগিতায় ১১০ গজ ফ্রিস্টাইলে প্রথম হয়ে, পাঁচ বছরের ছোট্ট আরতি স্বর্ণপদক আনতে গিয়েছিল গুরু শচীন নাগের কোলে চেপে। এরপর ভারতের নানা জায়গায় বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় দাপিয়ে সাঁতার কেটেছেন। ঘরে তুলেছেন বহু পুরস্কার। ১৯৫১ থেকে মোট ২২বার তিনি ছিলেন রাজ্য চাম্পিয়ান। বিদেশের মাটিতেও তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ে। আরতি সাহার ইংলিশ চ্যানেল জয় করার পিছনে তিনজনের অবদান ছিল সবচেয়ে বেশি। প্রথম, নামী সাঁতারু, প্রথম ভারতীয় হিসেবে ইংলিশ চ্যানেল জয়ী মিহির সেন। যাঁকে ১৯৬৯-এ গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস বইতে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ দূরগামী সাঁতারু হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়েছিল। দ্বিতীয়, অবিভক্ত ভারতের আর এক নামী সাঁতারু ব্রজেন দাস। যিনি প্রথম দক্ষিণ এশীয় ব্যক্তি ইংলিশ চ্যানেল পার হয়েছিলেন এবং ছ’বার ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে বিশ্ব রেকর্ড গড়েছিলেন।এঁরা দু’জন আরতি সাহাকে ইংলিশ চ্যানেল পার হওয়ায় উৎসাহ জুগিয়েছিলেন। যোগাযোগ করে দিয়েছিলেন। আর তৃতীয়জন হচ্ছেন আরতি সাহার সাহার স্বামী ডাক্তার অরুণ গুপ্ত৷ যিনি ছিলেন ডাক্তার বিধান রায়ের সহকারী৷ বিধান রায়ের তত্ত্বাবধানে প্রথমে দু’জনের রেজিস্ট্রি বিবাহ ও পরে সামাজিক বিবাহ হয়। ইংলিশ চ্যানেল অভিযানে যে বিপুল অর্থ ব্যয় হয়,তা বিভিন্ন বিশিষ্ট মানুষজনদের কাছ থেকে সংগ্রহ করেছিলেন অরুণ গুপ্ত। মুখ্যমন্ত্রী বিধান রায়, প্রধান মন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর কাছ থেকেও সাহায্য, সহযোগিতা পাওয়া যায়। আরতি সাহা প্রথম মহিলা ক্রীড়াবিদ যিনি ১৯৬০-এ পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত হন। ১৯৯৪, ২৩ অগস্ট মাত্র ৫৪ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয় জন্ডিস ও এনকেফেলাইটিসে। আমরা কী ভুলে গেলাম এই বাঙালিনিকে!
Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.